Bhalkimachan – A Refreshing Weekend Getaway with Jungle and Lonely Nature
ভালকিমাচান – জঙ্গলে ঘেরা নির্জনতায় ভরা সপ্তাহান্তের এক ঠিকানা
জঙ্গলের মাঝে একটি সুন্দর দোতলা লজ। চারপাশে শুধুই বিস্তীর্ণ সবুজ জঙ্গল ও নির্জনতায় মোড়া প্রকৃ্তি। জায়গাটি এতই নিস্তব্ধ, যে মাঝেমাঝে শুধু পাখির ডাক বা হাওয়ায় গাছের পাতা নড়ার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ কানে আসে না। সপ্তাহান্তে নিরিবিলিতে আবকাশ যাপনের এক আদর্শ ঠিকানা। ভালকিমাচান। কলকাতার কাছেই বর্ধমান জেলায় জঙ্গলে ঘেরা এক দারুণ উইকএন্ড ডেস্টিনেশন। পর্যটন মানচিত্রে নব সংযোজন। লজটির নাম ‘অরণ্য সুন্দরী রিসর্ট’। কলকাতা থেকে ১৩৫ কিমি ও বর্ধমান শহর থেকে দূরত্ব মাত্র ৪৩ কিমি। এখনও হয়ত লোকচক্ষুর সামনে তেমন ভাবে উন্মোচিত হয় নি এ জায়গাটি।
শীতের শেষে সপ্তাহান্তের ভ্রমণে কোন অদেখা, নতুন জায়গার খোঁজে ঠিক করে ফেললাম এবার গন্তব্য ভালকিমাচান। একটি ট্র্যাভেল ম্যাগাজিনে পড়ে ও এক অফিস কলিগের কাছে শুনে জেনেছিলাম জায়গাটির হদিশ। ওয়েবসাইট থেকে নম্বর নিয়ে দুটি ঘর বুক করেছিলাম অরণ্য সুন্দরী রিসর্টে। নির্দিষ্ট দিনে সপরিবারে, সকাল ৬টায় হাওড়া স্টেশন থেকে ব্ল্যাক ডায়মন্ড এক্সপ্রেসে চেপে পৌঁছই মানকর স্টেশনে। বর্ধমান – আসানসোল লাইনের এক স্টেশন মানকড়। আগে থেকে বলে রাখায় অরণ্য সুন্দরীর ম্যানেজার গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল স্টেশনে। সেই গাড়িতেই আধ ঘণ্টায় পৌঁছে যাই ১৩ কিমি দূরের ভালকিমাচানে।
অরণ্য সুন্দরীর দোতলায় আমাদের জন্য বরাদ্দ দুটি ঘর। বেড়া দিয়ে ঘেরা কম্পাউন্ডের বাইরেই শুরু শালের জঙ্গল। বারান্দায় বসলে সামনের বিস্তীর্ণ জঙ্গলের পানে চেয়ে, পাখির ডাক শুনে, সময় কেটে যায়। জঙ্গলের ঘ্রাণাস্বাদন করে মেলে এক অনাবিল আনন্দ। নামে রিসর্ট হলেও ‘অরণ্য সুন্দরী’ সাধারণ সাজের। তবে জঙ্গলের মাঝে মৌলিক সব সুযোগ সুবিধা, স্বাচ্ছ্যন্দ ও সুস্বাদু আহারের ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। উঠোন মত জায়গাটায় একটা বড় আম গাছ। আর তার নিচে বড় একটা কড়াইয়ে, কাঠের জ্বালে, চলছে রান্না। অনেকটা পিকনিকের মেজাজে। লুচি তরকারী সহ জলখাবার সেরে বেরোলাম আশপাশটা একটু ঘুরে দেখতে। লালমাটির রাস্তা ধরে, গাছ থেকে ঝরে পড়া শুকনো পাতা মাড়িয়ে।
ভালকিমাচানের জঙ্গল ছিল একসময় বর্ধমান রাজাদের প্রিয় শিকারভূমি। ভালুক শিকার ছিল তাদের এক প্রিয় খেলা। সেই থেকেই এই স্থানটির নাম হয় ‘ভালুকি মাচান’ বা ভালকিমাচান। মূল সড়কের একপাশে রয়েছে সে যুগের শিকারের জন্য বানানো একটি ওয়াচ টাওয়ারের নিদর্শন। ওয়াচ টাওয়ারের নিচে রয়েছে একটি কুয়োর মত সুড়ঙ্গ, যার মুখ এখন লোহার পাত দিয়ে আটকানো। ভালুকের নামে যখন জায়গার নাম, তখন ভালুকের দেখা কি মিলবে এ জঙ্গলে? এ রোমাঞ্চকর প্রশ্নটা এসেছিল আমাদের মনে। না, আজ আর এ তল্লাটে ভালুক নেই। শুধু অরণ্য সুন্দরীর সামনে একটা ভালুকের কৃষ্ণকায় মূর্তি বানানো, সেটা দেখেই ক্ষান্ত থাকতে হবে। শুধু ভালুক কেন, এ জঙ্গলে কোনো হিংস্র জানোয়ারের আস্তিত্বই আজ নেই। রয়েছে সামান্য কিছু বুনো শুয়োর, শিয়াল ইত্যাদি, যার কদাচিৎ দেখা মেলে। আর রয়েছে প্রচুর পাখি। তবে সাপের ভয় আছে নাকি এ জঙ্গলে। যদিও সময়টা শীতের শেষ বলে, ব্যাপারটায় তেমন আমল দিলাম না।
পিচের সড়কটি মানকড় ও অভিরামপুরের দিক থেকে এসে ভালকিমাচানকে ছুঁয়ে, অরণ্যের বুক চিড়ে ৩২ কিমি দূরের বোলপুরের দিকে চলে গেছে। মূল সড়ক থেকে নেমে আসা লালমাটির রাস্তা ধরে ১০০মিটারের মধ্যে লজটি। জঙ্গলে ঢাকা লজটির অবস্থান এমন, যে মূল রাস্তা থেকে তা টাহর করা যায় না। একসময় স্থানীয় পঞ্চায়েত নির্মাণ করিয়েছিল বনের মাঝে এই বাড়িটি। এখন এটি পর্যটনের জন্য ব্যবহার হয়। একটি বেসরকারী সংস্থাকে লিজ দেওয়া হয়েছে। লজের পাশেই রয়েছে একটি কৃ্ত্রিম লেক। সুবিশাল লেকের চারপাশ বাঁধানো, নানান গাছে ঘেরা। পর্যটকদের জন্য রয়েছে বসার জায়গা ও লেকের জলে বোটিংয়ের ব্যবস্থা। ভালকিমাচান একটি পিকনিক স্পটও বটে। পিকনিকেরে জন্য লজের বাইরে বনের ভিতরে রয়েছে নির্দিষ্ট জায়গা।
না, ভালকিমাচানে কোন পাহাড় নেই। জঙ্গলে বাঘ, ভাল্লুকও নেই সে কথা আগেই বলেছি। সাইট সিয়িংয়েও তেমন কিছু দেখার নেই। শুধু বিস্তীর্ণ শালের জঙ্গল ও অখন্ড নীরবতাই ভালকিমাচানের মূল আকর্ষণ। সবচেয়ে কাছের গ্রামটি এখান থেকে ২ কিমি। সবচেয়ে কাছের বাজার আভিরামপুরে, ৪.৫ কিমি দূরে। এখানে অবকাশ যাপনের সময় মনে হতেই পারে, যেন সভ্যতার কোলাহল থেকে বহু দূরে কোথাও চলে এসেছি। জঙ্গলের মাঝে দুদিন জিরোনোর মজাটাই আলাদা, বেশ থ্রিলিং লাগবে, আবার মনের প্রশান্তিও আনবে। তবে ছুটির দিনে কোন বেয়াড়া পিকনিক পার্টির আগমনে জায়গাটার নিস্তব্ধতা ও মাধুর্য্য খানখান হতে পারে ক্ষণিকের জন্য, সে অভিজ্ঞতাও হয়েছিল কিঞ্চিৎ।
দুপুরে আহারাদি ও বিশ্রামের পর কম্পাউন্ডের বেড়ার গেট পেরিয়ে পায়ে পায়ে চললাম জঙ্গলের অন্দরে, বিকেলের মিঠে রোদ গায়ে মেখে। লালমাটির শুঁড়ি পথ চলে গেছে জঙ্গলের গভীরে। শুকনো ঝরা পাতা মাড়িয়ে চলেছি সে পথে। মূলতঃ মাঝারি উচ্চতার বৃক্ষ ও ঝোপঝাড় নিয়েই এই অরণ্য, কয়েক বর্গ কিলোমিটার জুড়ে। শাল গাছই এ জঙ্গলে প্রধান। এছাড়াও রয়েছে শিমূল, সিরীষ প্রভৃতি গাছ। শীতের শেষে পর্ণমোচী জঙ্গল অপেক্ষাকৃ্ত পাতলা। তাই খানিকটা দূর অবধি দেখা যাচ্ছে, এটাই ভরসা। তাছাড়া এ জঙ্গলে কোনো হিংস্র জানোয়ার নেই সেটাও জেনে গিয়েছিলাম। এসময় জঙ্গলে যেমন পাতা ঝরে পড়ছে, তেমনই গাছে গাছে বসন্তের নতুন সবুজ পাতার আগমন। কোলাহল মুক্ত, দূষণ মুক্ত পরিবেশ। গহীন অরণ্যের মাঝে এরকম পায়ে হেঁটে ভ্রমণ বেশ রোমাঞ্চকর। এর মজাটাই আলাদা। তবে এসবের মাঝেই মনের কোণে বিষণ্ণতার সঞ্চার হল, জঙ্গলের ভিতর পিকনিকের দলের ফেলে যাওয়া থার্মোকলের থালা ও বর্জ্য দেখে। মানুষ হিসাবে অরণ্যের প্রকৃতির কাছে লজ্জিত বোধ হল।
সন্ধ্যের আগেই জঙ্গলের অন্দর থেকে বেরিয়ে এলাম। এরপর মূল পিচ রাস্তা ধরে খানিক হেঁটে চললাম। শুনশান, নির্জন রাস্তাটা। দুধারে জঙ্গল নিয়ে চলে গেছে বোলপুরের দিকে। কখনও কদাচিত এক আধটা গাড়ি বা মোটর বাইক আসা যাওয়া করছে। রাস্তার ধারে ধুতরো ফুলের গাছ। আছে পলাশ গাছও। খানিক বাদে পশ্চিমাকাশে জঙ্গলের উপর অস্তমিত সূর্য। পথের পাশে একটা কালভার্টের উপর বসে উপভোগ করছিলাম আরণ্যক পরিবেশ। বাতাসে একটা বুনো গন্ধ। সামনে রাস্তার বাঁক থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এল একটা লোক। লাঠি হাতে খুব দ্রুত পায়ে সে আসছে পিচ রাস্তা ধরে। আমাদের দেখে, হাত নেড়ে সতর্ক করে ফিরে যেতে বলল। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। লজ থেকে অনেকটা চলে এসেছি। তাই ফেরার পথ ধরলাম। ভয়ের কারণ কি সাপের উপদ্রব, নাকি অন্য কিছু, তা লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলে, তার গ্রাম্য বচনে জানানো উত্তরে ঠিক বোঝা গেল না। লোকটি চালের পুঁটুলি কাঁধে নিয়ে কয়েক কিমি দূরের কোন গ্রাম থেকে অভিরামপুরের দিকে যাচ্ছে। একেবারে অন্ধকার হবার আগেই সে বাসায় ফিরতে চাইছে বোঝা গেল। গ্রাম্য মানুষগুলোর জীবন এমনই।
আঁধার নামতেই জঙ্গলের আরেক রূপ। অন্ধকারেরও যে একটা রূপ আছে, তা যারা জানার তারাই জানে। বনের নানান গাছে ঝিঁ ঝিঁ র ডাক। মাঝে মধ্যে দু একটা রাতচরা পাখি ডেকে উঠছে। ফেব্রুয়ারীর শেষে জঙ্গলের মাঝে শীতের পরশ। আকাশে এসময় পূর্ণিমার চাঁদ নেই। তবে জ্যোৎস্না রাতে এ অরণ্যের রূপ কেমন লাগে, তা আরেকবার এসে দেখার ইচ্ছে রইল। নিশুত রাতে, নিস্তব্ধ জঙ্গলের মাঝে এই অরণ্য সুন্দরী রিসর্টে রাত কাটানো এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। তবে এসময় উইকএন্ডে রিসর্টে অনেক বোর্ডার থাকায়, বেশি নির্জনতা বা ভয়ের অনুভূতির অবশ্য তেমন কারণ ছিল না।
জঙ্গলকে ভালবাসলে, নিরিবিলি চাইলে, ভালকির জঙ্গলে অবসর যাপনের সময় অরণ্যের ঘ্রাণাস্বাদনে এক অনাবিল আনন্দ মেলে। যারা নির্জনতা পছন্দ করে ভালকিমাচান তাদের জন্য। ভালকিমাচানে এলে, জঙ্গলের মধ্যে মাইল খানিক হাঁটতে হাঁটতে, অখন্ড নীরবতাকে উপলব্ধি করে, অরণ্যের প্রকৃ্তিকে উপভোগ করে, নানান পাখির কুজন শুনতে শুনতে, উদাস হয়ে যাওয়া মনটা যেন শত ব্যস্ততা থেকে দুদিন মুক্তি পেয়ে একেবারে তাজা হয়ে ওঠে।
(এই ভ্রমণের সময়কাল ফেব্রুয়ারি ২০১৭)
প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য
যাতায়াত –
হাওড়া থেকে সকাল ৬টার ব্ল্যাক ডায়মন্ড এক্সপ্রেসে চেপে মানকড় স্টেশনে নেমে, সেখান থেকে গাড়িতে ১৩ কিমি ভালকিমাচান। মানকড় ছাড়াও বোলপুরগামী ট্রেনে বর্ধমান – বোলপুর শাখার গুসকরা স্টেশনে নেমেও গাড়িতে যাওয়া যায় ভালকিমাচান। গুসকরা থেকে দূরত্ব ১৮ কিমি।
ভালকিমাচান থেকে ১০কিমি দূরে যমুনাদিঘিতে রয়েছে মৎস্য দপ্তরের মাছ চাষের কেন্দ্র, অনেকটা জায়গা জুড়ে। কাছাকাছির মধ্যে ডোকরা শিল্পের গ্রামও দেখে নেওয়া যায়। এছাড়া ভালকিমাচান ঘুরে চলে যাওয়া যায় ৩২ কিমি দূরের শান্তিনিকেতনে।
থাকার জায়গা –
অরণ্য সুন্দরী রিসর্ট – যোগাযোগঃ ৯১৫৩৪২০১৩৩ (ম্যানেজার কাম কেয়ারটেকারঃ বঙ্কিম)
ভাড়াঃ ডাবল বেড রূমঃ ৮৫০-১২৫০, থ্রি বেড রুমঃ ১০০০-১৪০০ (সপ্তাহের ৫দিনের তুলনায় শনি-রবির ভাড়া বেশি হয়।)
এছাড়া কাছাকাছির মধ্যে ১০ কিমি দূরে যমুনাদিঘি তে থাকার জন্য রয়েছে মৎস্য দপ্তরের গেস্ট হাউস।
পরিশেষে দু-চার কথা
অরণ্য প্রকৃতির দান। মানুষের দায়িত্ব সেই অরণ্যকে রক্ষা করা। জঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে পরিবেশ নষ্ট করার কোন অধিকারই মানুষের নেই। এক্সকার্শন বা পিকনিকের নাম করে গিয়ে বক্স বাজিয়ে অরণ্যের নৈশব্দ ভেঙ্গে খানখান করা বা জঙ্গলে যত্রতত্র থার্মোকলের থালা, মদের বোতল, প্লাস্টিক ও অন্যান্য বর্জ্য ফেলে ছড়িয়ে নোংরা করা অত্যন্ত নিন্দনীয়। একসময় রাজারা বেহিসাবি শিকার করে এইসব জঙ্গলের বন্য প্রাণ প্রায় শেষ করে দিয়েছিল। এখন যুগ এগিয়েছে। অরণ্য যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তাকে রক্ষা করার জন্য আরো দায়বদ্ধ হোক মানুষ, আরো সচেতন হোক প্রশাসনও।
Travelogue and Photography by Subhrangsu Dasgupta
Phone no ta invalid.
really interesting!! would love visiting